সমাজ ও নারী

Bengali translation of Pakistan: Women and society (March 28, 2012)

সমাজের অন্যান্য দু:খ কষ্টের মত,নারীদের উপর নিপিড়ন ও অভিশাপ ক্রমাগতভাবে চলছেই এবং আর্থ সমাজিক সংকটের কারণে তা দিন দিন বৃদ্বি পাচ্ছে । এটা লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় যে, এমন এক সময় আর্ন্তজাতিক নারী দিবস পালন করা হচ্ছে, যখন অসংখ্য নারী সহিংসতা,হত্যা, এসিড ছোঁড়া ও ধর্ষনের মত চরম নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে এবং তা প্রতিনয়ত বেড়েই চলছে । এইরূপ র্স্পধার্পূন তৎপরতার বিরুদ্ধে অজ পর্যন্ত বৃহৎ আকারে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা  হয়নি । বরং মোল্লা এবং কনজারভেটিভ রাজনীতিবিদগণ অন্ধভাবে এইসব অপরাধ জনক কর্মকান্ডের নিরব সমর্থন ও অপরাধীদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন । এই সকল বিষয়ে বেশীরভাগ রাজনৈতিক ও সামাজ কর্মীদের কার্যক্রম কৃত্রিম ও লোক দেখানোর মধ্যেই সীমাদ্ধ ।

জিয়ার ঘৃণ্য একনায়কতন্ত্রের আমলে রক্তচুষা যে সকল আইন কানুন নারীদের বিরুদ্বে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল তা বিগত ২৪ বছরে ও বাতিল করা হয়নি । আমাদের সমাজে আজ ও সকল রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক মন মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যায় । নারীদের বিরুদ্বে সহিংসতা ও বৈষম্য প্রতিরোধে পাশ হওয়া  প্রতিটি আইন ও কার্যক্রমকে আমরা স্বাগত জানাই । কিন্তু যদিও বেশ কিছু আইন প্রচলিত আছে তবু নারীদের জীবন যাত্রায় তেমন কোন উন্নতি সাধন করতে পারেনি এবং সময়ের মাপকাটিতে নিপিড়িত নারী সমাজে কোন পরিবর্তন এখনও দৃশ্যমান নয় । আর শ্রমিক নারীদের জীবনে তো দ্বিগুন তিনগুন নির্যাতনের মাত্রা চেপে আছে । নারীরা সমাজে ও পরিবারে উগ্র পুরুষতান্ত্রিকতার ও যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছে । 

মুল কথা হলো, নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে জেন্ডার ইস্যূ গুলোই প্রকৃত সমাধান করতে পারবেনা এবং ইহা সত্যিকার কৌশলও নয় ; নারী মুক্তির জন্য সর্বাগ্রে বুঝতে হবে নারী নিপিড়নের গভীরতর  সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ সমূহ যা জেন্ডার ভিত্তিক শোষন প্রক্রিয়ার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত । জেন্ডার ইস্যূ ও শ্রেণীর প্রশ্নের আন্তঃসর্ম্পকের মিমাংসাই আমাদেরকে নারী স্বাধীনতার সংগ্রামে  সফলতা এনে দিতে পারে।

আজ পাকিস্তানে  বহু নারী বিপুল  সুনামের সাথে রাজনীতি,ব্যবসা,শিল্প সহ নানা বিভাগে কৃতিত্বের সহিত জায়গা করে নিয়েছেন । কিন্তু তাদের প্রায় সকলেই এসেছেন শাসক শ্রেণী, উচ্চ বিত্ত ও মধ্য বিত্ত শ্রেণী থেকে এসেছেন । তাদের সমস্যা ও দুঃক কষ্ট আর নিম্ন বিত্তশ্রেণীর মেহেনতীনারীদের জীবন সমস্যা এক নয় ।

যদি কোন নারী নিম্নশ্রেনী থেকে উঠে আসে তবে সে ও খুব দ্রুতই উচ্চবিত্তের সাথে মিশে যায় এবং নিজের শ্রেণীর নারীদের কথা বেমালুম ভুলে যায় । মোট কথা হলো, এটাই স্বাভাবিক বিষয় সামাজিক বস্তুগত পরিস্থিতিই এর আসল কারন, ইহা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয় । আসল সমস্যা হলো, স্বাধীনতা বলতে নারীদের আজ যে মন ও মানসিকতা তৈরী হয়েছে তাতে তরা নিজেরাই একটি পণ্যে রূপান্তরিত হয়ে, প্রদর্শণী ও বিজ্ঞাপনের প্রধান উপাদানে পরিনত হয়েছেন । অন্যদিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে তাদেরকে গৃহে আটকে রেখে দাসীতে পরিণত করে ব্যাক্তিগত সম্পদে পরিণত করতে চায় এবং অভিজাত শ্রেণী নারীদেরকে তাদের ব্যবসার প্রসার ও মুনাফা লাভের হাতিয়রে রূপান্তর করতে তৎপর । যদি ও ভদ্রচিত ভাবে নারীদের  সাথে এই নির্মম আচরন করা হচ্ছে, নারীগণ তা মেনে নিয়ে পণ্যবিক্রির মাধ্যমে মুনাফা লাভ করে দিয়ে ও তাদের পরিত্রান মিলছে না । নারীদের প্রতি বৈষম্য মূলক আচরন চলমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক উৎপাদন সর্ম্পকের কারনেই তৈরী হয়েছে । এবং এ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সীমাহীন অর্থলোভ ও লালসার । ফলে এই রূপ দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের গভীরে অনুপ্রবেশ করেছে, এবং ইহা সমাজ ব্যবস্থা দ্বারাই লালিত হচ্ছে । সমাজ ব্যবস্থার বস্তুগত অবস্থার পরিবর্তন ও আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিরি  আমূল পরিবর্তন ছাড়া  এই ঘৃন্য মানসিকতার পরিবর্তন হবে না । 

পুঁিজবাদের আওতায় এটা ধরেই নেয়া হয় যে,নারীরা গৃহবিত্তিক নানা কাজ ও অন্যান্য বিষয়ে শ্রমদান  করবে । গৃহের কাজ কর্মসম্পাদন, শিশুদের লালন পালন ও বড় করে তোলা সহ নানাহ প্রকৃতির কার্যক্রম বিনা পারিশ্রমিকে করার জন্য নারীদেরকে প্রচলিত সমাজ দয়িত্ব প্রদান করে রেখেছে । ফলে তাদের এই অতিব গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করাকে সমাজে ও অর্থনীতিতে অবমূল্যায়ন করে আসছে । একটু ভিন্নভাবে বিষয়টিকে দেখলে আমরা দেখতে পাব যে, মুনাফা লাভের জন্য শ্রেিকর বেতন কমানোর সূত্র থেকেই এর ঊৎপত্তি হয়েছে । মহান লেনিন প্রাভদা নং ১০২ এ লিখেছিলেন যে,“ বর্তমানে সমাজে বহু প্রকার দারিদ্র ও নিপিড়নকে আড়াল করে রেখেছে যা প্রাথমিক ভাবে চোখে পড়ে না । কর্ম সময়ে, কর্মস্থল ও পরিবার উভয়কে সঠিক ভাবে পরিচালনা করতে গিয়ে দরিদ্র ও শহুরে  বিচ্ছিন্ন পরিবার গুলো, শিল্পী, শ্রমিক, কর্মকর্তা এবং ছোট ছোট অফিস কর্মচারীরা তাদের জীবনে অভিশ্বাস্য রকম অসুবিধায় বসবাস করছে । মিলিয়ন মিলিয়ন নারী এইরূপ পারিবারিক জীবনে গৃহদাসী হিসাবে দিনাতিপাত করে আসছে । পরিবারের সামর্থানুসারে তাদের খাদ্য, কাপড় ও অন্যান্য বিষয়ে অর্থ খরচ করেই সম্পাদন করা হয় , শুধুমাত্র তারা নিজেদেরে পারিশ্রমিকটিই পান না ।  পুজিঁপতিগণ তাদের প্রয়োজনে নারীদেরকে নিয়োগ দান করে খুবই অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে । তারা ও নিয়োজিত হয় ভাত কাপড় ও নিজেদের কিছু অতিরিক্ত আয়ের জন্য” । 

আজকাল ধনী পরিবারের নারীরা তাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার আলোচনার মাঝে গৃহের চাকরবাকর,ফ্যাসান এবং বিবাহ শাদীর আয়োজন ইত্যাদী বিষয়  নিয়েই ব্যস্ত থাকে । এই সমস্ত আবার নির্ভর করে তুলনামূলক ভাবে তাদের সম্পদের পরিমান,সামাজিক অবস্থা,ব্যবসা এবং নিজস্ব চাকুরী ও কর্মকান্ডের উপর । এগুলো ও আবার নির্ভর করে তাদের দেখা নাটক ও টিভিতে প্রদর্শিত ধারাবাহিক গুলোর বিষয়বস্তুর উপর । এই স্তরের নারীদের জীবন যাত্রায় মোল্লাদের নিদের্শনা ও তথাকথিত ভাল চরিত্রের মহিলাদের প্রভাব ও কম নয় । শ্রেণী বিভক্ত শোষণ মূলক সমাজ ব্যবস্থার কারেণেই নারীদেরেকে এইরূপ পরিস্থিতিতে জীবন নির্বাহ করতে হয় । নারী গৃহকর্মী ও শ্রমজীবি মহিলাদের জীবনের প্রয়েজন ও আলোচনার বিষয় সম্পূর্ন আলাদা । তাদের ভাবনা হলো, কবে গৃহবিত্তিক দাসত্ব ও শ্রমশৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবে এবং চলমান শ্রমব্যবস্থার পরিবর্তন হবে ।

এইরূপ অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া সমাজে, একজন নারীর মুক্তি তখনই শুরু হয়, যখন সে হাতের কছে সঞ্চালিত পানির টেপ থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারে, যা তাকে একসময় বহু পরিশ্রম করে বহু দূর থেকে কলসী ভরে খাবারের জন্য আনতে হত ।  প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধমে, গৃহবিত্তিক শ্রমের বিষয়টি খুব সহজেই পরিবর্তন করে শ্রমসাধ্য বিষয়গুলো সহজ সাধ্য করা যেতে পারে । শুধুমাত্র সমাজিক রান্ন্াঘর স্থাপনের মাধমেই আজকের গৃহশ্রমিকগণ অন্যান্য নাগরিকদের মত সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে পারেন । বেশীরভাগ গৃহবিত্তিক সহিংসতার উৎসই অর্তনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সম্পৃৃক্ত ; সামাজিকভাবে দারিদ্রতা রেখে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ ও নির্মূল করা যাবে না ।

 একই ভাবে নারীরা খুব স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করে থাকেন এমনকি বহু উন্নত পুজিঁবাদী দেশে ও তা চালু আছে । শ্রম দাসত্ব থেকে পতিতাবৃত্তি হলো মহিলাদের জন্য এক জগণ্য অভিষাপ, যা শ্রেণী বিভক্তি থেকে সৃজিত হয়েছে । যেখানে সমাজের উঁচু তলার লোকেরা মানুষের রক্তশোষকে পরিনত হয়েছে । পরিকল্পিত ভাবে ও শোষক শ্রেণীর প্রয়োজনে  আদর্শ ও নৈতিকতা তাদের শোষন প্রত্রিয়াকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য শ্রমজীবি নারী সমাজের উপর চাপিয়ে দেয় । এই সমাজ ব্যবস্থার অবসান করতে হলে একমাত্র পথই হলো শ্রেণী সংগ্রাম । যার মাধ্যমে শ্রমজীবী নারী ও পুরুষ  ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই ব্যবস্থকে ছোঁড়ে ফেলবে  । ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন প্রবনতা এই শ্রেণী সংগ্রামকে বিভক্ত করে ফেলবে । যেমন ফ্যামিনিজম,জাতিয়তাবাদ,ধর্ম অথবা অন্য যে কোন প্রকারের অবিবেচনা প্রসূত প্রতিক্রিয়াশীলতা ও পশ্চাৎ পদতার জন্ম দেবে ।

অনুবাদ : একেএম শিহাব