মায়ানমার আন্দোলনঃ বিপ্লবের পূর্বাভাস

মায়ানমারে ঘটে যাওয়া মিলিটারি ক্যু এর ফলে গণঅভ্যুত্থানের নতুন মাত্রা দেখা দিয়েছে গত কিছুদিনে।সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণ থেকে বাঁধা দিতে  জনগণের দৃঢ় সংকল্পের ব্যাপারটি ক্রমবর্ধমান আন্দোলন আর ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে দেখা প্রকাশ পাচ্ছে৷   সামরিক জান্তা স্পষ্টভাবেই জনগনের দ্বারা যে বিরোধীতার শিকার হচ্ছে, তাকে আগ্রাহ্য করে চলছে। নাগরিক আন্দোলন ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। মিলিটারির কর্তাব্যক্তিদের কাছে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় বলো এই আন্দোলন কেবলমাত্র রাস্তা’র বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ সমাবেশে সীমাবদ্ধ নেই, তা ব্যাপক ধর্মঘটে পরিণত হয়েছে।    যেমন নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে:

“নাগরিক আন্দোলন, বা সিডিএম হিসাবে পরিচিত, সারা দেশে ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে।  এটি সামরিক বাহিনীর ব্যবসায়িক স্বার্থ আর তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ করছে, তার সাথে সাথে রাস্তায় নেমে  বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই তারা পাতিল এবং কড়াই দিয়ে উচ্চস্বরে আওয়াজের মাধ্যমে চারপাশ বিদীর্ণ করছে নিজেদের বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য।  

“১৯৮৮ ও ২০০৭-এ সামরিক বাহিনী কতৃক  গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের হত্যা করার নৃশংস ইতিহাসের কারণে সমর্থনের  প্রবাহ আরো তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের সিভিল সার্ভিস সিস্টেমের একজন বিশেষজ্ঞ অনুমান করেছেন, সেই সময় দেশে প্রায় ১০ লাখ বেসামরিক কর্মচারী ছিল এবং  তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছিল।  দেশকে চলমান রাখতে যারা ছিল অনিবার্য”  (নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১)

বিপুল জনসাধারণের আন্দোলন

ছাত্রদের বিক্ষোভ বা নাগরিক অধিকারের বিক্ষোভগুলোর মুখোমুখি হওয়া সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি যখন আন্দোলনে নামতে শুরু করে তখন আন্দোলনের প্রকৃতি বদলে যায়। শ্রমিক শ্রেণী এমন এক শক্তি যা সমাজকে পরিবর্তন করতে পারে;  তারা পুরো দেশকে পঙ্গু করে দিতে পারে। আর যদি এদের যোগ্য নেতৃত্ব থাকতো তবে তারা অন্যান্যা গোষ্ঠী, তরুন , মধ্যবিত্ত , কৃষক, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সকলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতো। এবং শুধু সেনা শাসনকেই গুড়িয়ে দেওয়া নয়, পাশাপাশি পুঁজিবাদের উচ্ছেদও সম্ভব হতো, যে পুঁজিবাদই মুলত বর্তমানের এইসব পরিস্থিতির মূল কারণ । 

মায়ানমারের ট্রাজেডিটি হলো সেখানে শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে এমন কোনো নেতৃত্ব নেই যারা এই ঠুনকো গণতান্ত্রিক দাবিটির উর্ধ্বে যেতে পারে। তা সত্ত্বেও, শ্রমিকশ্রেণী এখন পর্যন্ত ঠিক পথেই আছে। তারা সংগঠিত হচ্ছে, ধর্মঘটের জন্য কমিটি নির্বাচনসহ আরো অনেক কাজ করছে। শ্রমিক নেতাদের এই ভূমিকা পালনের নজির দেখে বুঝা যায় ধর্মঘটে তারা সামনে থেকে অংশগ্রহণ করছে, কারন ৪০০ এর বেশি মানুষকে এই ক্যু এর সময় গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যেও শ্রমিকশ্রেণীর অনেকে আছেন। 

ইয়াঙ্গুনে যারা প্রথম গণআন্দোলনের আগুন জ্বালিয়েছিলেন তাদের একটি  হল এফজিডব্লিউএম - যা আগে ফেডারেশন অফ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স মায়ানমার নামে পরিচিত ছিল।  তবে এখন এটি প্রসারিত হয়ে সাধারণ শ্রমিক ইউনিয়নে পরিণত হয়েছে- যার সদস্য সংখ্যা কয়েক হাজার।

এফজিডব্লিউএম-এর নেতা মো সান্দার মিন্ট এই আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন।   তিনি থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: "শ্রমিকরা আগে থেকেই ক্ষ্যাপা ছিল, আগে থেকেই সক্রিয় ছিল। নিপীড়িত হওয়ার এই পরিচিত বোধটি আবার ফিরে এসেছে এবং তারা চুপ করে থাকতে পারেনি।  তাদের কেবল অনুসরণ করার জন্য কারো দরকার ছিল - আর এ কারণেই আমি ধর্মঘট শুরু করার সাহস পেয়েছি। 

 তিনি অভ্যুত্থানের পরের দিনগুলিতে শ্রমিকদের একত্রিত করার কাজ করেছিলেন এবং লোকদের "শেষ অবধি সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার" আহ্বান জানিয়েছিলেন।  সামরিক বাহিনী তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে দমানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তিনি কৌশলে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন।  একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন: “রাতের বেলা আমাকে আন্দোলনের কৌশল সম্পর্কে কাজ করতে হয় - কীভাবে ধর্মঘট করতে হবে, কোথায় প্রতিবাদ করতে হবে - এবং তারপরে শ্রমিকদের আহবান জানাতে হবে: কখন, কোথায় এবং কীভাবে আমরা এই সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাবো।  আমি অনেক হুমকির মধ্যে আছি... তবে আমার মুখ বন্ধ করা যাবে না।"

 দুর্ভাগ্যক্রমে, তিনি যখন অন্যান্য ইউনিয়নগুলোকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানিয়েছিলেম, অনেক ইউনিয়ন নেতারা শান্ত থাকার কথা বললেন, গন্ডগোলে না জড়াতে বললেন।   কিন্তু নিম্নশ্রেণী থেকে চাপ ক্রমশ বাড়ছিল, এবং মেডিকেল কর্মীরা আর সরকারী কর্মীরা ধর্মঘটের পদক্ষেপে বেরিয়ে আসতে শুরু করার সাথে সাথে বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন সংস্থার একটি জোট গঠিত হয়েছিল।  মো সান্দার মাইন্ট জোর দিয়ে বলেন : “শ্রমিকরা এই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।  আমরা জানি যে সামরিক একনায়কতন্ত্রের মধ্যে দেশের পরিস্থিতির শুধু অবনতিই  ঘটবে, তাই আমরা শেষ পর্যন্ত এক হয়ে ,ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করব। ”

অন্যান্য সেক্টরে কাজ করা সাধারণ শ্রমিকরা ও স্থানীয় শ্রমিক নেতারাও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। বেসামরিক কর্মচারী, ডাক্তার ও শিক্ষকরা ধর্মঘটে নেমেছেন। ইয়াঙ্গুনের একটি শিল্প অঞ্চল হ্লাইং থারিয়ার পাঁচ হাজার কর্মী ধর্মঘটে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, তাদের কথা হলো, সামরিক জান্তা যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততোদিন তারা রাস্তায় অবস্থান করবেন। 

বিপুল সংখ্যক ব্যাংক কর্মীরাও ধর্মঘটে অংশ নিয়ে এই নাগরিক বিদ্রোহ যোগ দিয়েছেন। বৃহত্তম বেসরকারী ব্যাংকগুলির মধ্যে অন্যতম কেবিজেডকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্টেট ব্যাংক আর মিয়ানমার অর্থনৈতিক ব্যাংক - যারা সরকারি বেতন প্রদান করে, এরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন এমন কর্মস্থলগুলির তালিকা অসংখ্য। 

এর আগে ২০০৭ সালে 'জাফরান বিপ্লবের' সময়েও রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ হয়েছিল, কিন্তু আমরা আজ যেটা দেখছি তার মতো করে সামরিক জান্তার অর্থনৈতিক স্বার্থকে আঘাত করার স্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কোনও ব্যাপক ধর্মঘট দেখা যায় নাই। বর্তমানে চলমান এসব আন্দোলনের জোয়ার মূলত জনগণের চৈতন্য ও চিন্তাপদ্ধতির ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতির চিহ্ন বহন করে এবং দেখায় যে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

 গত এক দশকে, সেনাবাহিনী বেসামরিক শাসনের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পরে এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পরে মায়ানমারে এক তরুণ ও সংগ্রামী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।  এই নতুন, তরুণদের দিয়ে গঠিত সংগঠনটিই ছাত্রসমাজের সাথে মিলে প্রথম অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সরব হয়।  এই নতুন প্রজন্মের নেতাদের নেতৃত্ব অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোকেও আন্দোলনে নামার জন্য প্রেরণা জোগায়। শ্রমিকরা ভুলে যায় নাই যে, পূর্ববর্তী সামরিক শাসনামলে তাদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার রদ করা হয়েছিল, এবং তারা আর ওই পুরনো দিন ফিরিয়ে না আনতে বদ্ধপরিকর। 

দমন করেও থামানো যাচ্ছে না 

সেনাবাহিনী সেই চিরচেনা উপায়েই শ্রমিক ও যুবসমাজের এই ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের জবাব দিচ্ছে, সেটা হচ্ছে দমন-পীড়ন। তারা আচমকাই বারবার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিচ্ছে। এটি তাদের রাতে রাতে বাড়ি গিয়ে জনপ্রিয় এক্টিভিস্টদের গ্রেফতার করতে সাহায্য করে।   বেশ কয়েকজন নামীদামী ব্যক্তিকে এভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷

তারা রাস্তায় সহিংসতার মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছে- জল কামান ব্যবহার করা, রবার বুলেট ছোড়া, এমনকি বিক্ষোভের মধ্যে গুলি চালানো। এসবের মধ্যে একজন তরুনী মাথায় আঘাতের পরে গুরুতর অবস্থায় আছে এবং রাজধানী নাইপিডোতে আরও চারজনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে আরো অনেকে আহত হয়েছেন। উত্তরের শহর মাইতকাইনায় একটি বিদ্যুতের গ্রিড বন্ধ করার লক্ষ্যে জনতা জড়ো হলে, সৈন্যরা সেখানেও গুলি ছোড়ে। 

রাস্তায় সামরিক যানবাহন এবং বিশেষ বাহিনীর সর্বত্র উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনগণকে রাস্তায় না নামার জন্য ভয় দেখানো। তবে দমন-পীড়নের ফলে জনসাধারণের ক্ষোভ উলটো আরো বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিকতম প্রতিবাদগুলিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মানুষ দেখা গেছে, এর প্রতিক্রিয়ায় করা প্রেস কনফারেন্সে সামরিক জান্তা দাবি করেছে তারা নাকি কোনো সেনা অভ্যুত্থান ঘটায় নাই!

প্রতিবাদকারীদের হাত থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য সামরিক শাসকরা বারবার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জনগণের দৃষ্টি থেকে দূরে থেকেই কাজ করে, তবে আমরা এখন আর ১৯৯৮ বা ২০০৭ সালে পড়ে নেই। সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ করার শত চেষ্টা স্বত্তেও, আন্দোলন আরো বেগবান হচ্ছে৷ 

মায়ানমারে সোমবার সারাদিন ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ছিল, এছাড়া সেদিন ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় ভারী সাজোয়া যান আর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উপর নির্মম হামলার জন্য কুখ্যাত ৭৭ তম পদাতিক ডিভিশনকে মোতায়েনের পরও জনসাধারনের ঢল পুরো শহরজুড়ে উপচে পড়েছে৷ সেনাবাহিনীর এই আচরণ জনগনের প্রতি একটা স্পষ্ট হুমকি যে যদি তারা আর আন্দোলনে থাকে, তবে রক্তের বন্যা বয়ে যেতে পারে। মায়ানমারের সামরিক রেকর্ডও খুবই নির্মম, যেমন বলা যায় ১৯৮৮ সালের কথা, যখন তারা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। 

তবুও, জনগণ নির্বিকার, রাস্তায় রয়েছেন এবং সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জও করেছেন। এটি স্পষ্ট যে এখন অবধি নেওয়া সমস্ত পদক্ষেপের কাঙ্ক্ষিত কোন প্রভাব নেই। সেনাবাহিনী এ জাতীয় ব্যাপক বিরোধিতার মুখে মরিয়া হয়ে উঠছে। তারা একটি নতুন আইন প্রবর্তন করেছে যার ফলে রাস্তায় সৈন্যদের অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইলে যে কাউকে ২০ বছরের কারাদন্ড দেওয়া যাবে। 

সেনাপ্রধানরা কেবল আদেশ দিতেই  অভ্যস্ত।  তাদের একটি সামরিক মানসিকতা রয়েছে।  কয়েক দশক ধরে সবকিছু তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং তারা ভেবেছিল যে এবারো সহজে নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেওয়া যাবে। তবে তাদের এই হিসাব আসলে ভুল। বিদ্যমান  পরিস্থিতিতে এটা প্রমাণিত যে তাদের দেশে তাদের সামাজিক ভিত্তিটি খুব ছোট এবং তারা কেবল তাদের নিপীড়ক সামরিক যন্ত্র এবং লুম্পেন গোষ্ঠীগুলোর উপরই নির্ভর করতে পারে। আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তারা ২৩০০০ অপরাধীকে  মুক্ত করে দিয়েছে যাতে করে জনগণকে ভয় দেখানো যায়৷   কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারে নাই যে আপনি সম্পূর্ণ জনগণকে সামরিক আদেশ দিতে পারবেন না,  বিশেষ করে যখন তারা বিদ্রোহে জেগে উঠেছে।

জনগণের প্রতিরোধের মাত্রা এতো মজবুত যে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে তাদের সম্প্রদায়ের সুরক্ষা এবং স্থানীয় আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তারে সামরিক বাহিনীর প্রচেষ্টা প্রতিহত করার জন্য পাহারাদার দল তৈরি করা হয়েছে।

জাতীয় প্রশ্নে (জাতীয়তাবাদের অসাধু সুবিধা নেয়ার প্রচেষ্টা)

মায়ানমার সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের সাথে নৃশংস আচরণের জন্য কুখ্যাত, বিশেষ করে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীদের সাথে তাদের আচরণের জন্য।  এখন উদ্ভূত পরিস্থিতিটির মধ্যে পরিহাসের বিষয়টি হল, সেনাবাহিনী মরিয়া হয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নেতাদের সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।  কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা আগে কারাগারে থাকা কয়েকজন নেতাকে মুক্তি দিয়েছে।

যেহেতু সামগ্রিকভাবে সমাজে সেনাবাহিনী সামাজিক ভিত্তিটি খুব দূর্বল, তাই তারা "বিভাজন এবং শাসন" এর খেলা খেলছে। তবে এবার তাদের পদ্ধতিটি উলটো।  তাদের সাধারণ নীতি হ'ল বামার / শভিনিস্টদের প্রভাবিত করে তাদের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া।  যেমন রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে এ ঘটনাটি ঘটেছিল।  এখন তারা জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের রাস্তায় বিক্ষোভকারী বামার শ্রমিক ও যুবকদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন। 

সামরিক প্রধানরা সুচি এবং এনএলডির প্রতি জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্ষোভকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন।  তারা জাতিগত সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের সামরিক প্রশাসনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।  এর উদাহরণ হলো কায়ান পিপলস পার্টির মাহন নইং মাং,যিনি ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে হেরেছিলেন, কিন্তু এখন তিনি সামরিক সরকারে জায়গা পেয়েছেন। 

ক্ষমতায় আসার আগে সূচি জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।  এরফলে মায়ানমারের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী  ২০১৫ সালের নির্বাচনের সময় সুচি ও তার দল এনএলডিকে সমর্থন দিয়েছিল, যাতে তারা ফেডারেল ব্যবস্থার অধীনে স্বাধিকারের লড়াইয়ে এগিয়ে যেতে পারে। সেইসময় এনএলডি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা শান্তির পক্ষে কাজ করবে এবং বিভিন্ন জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাবে। যেহেতু সেইসময় কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে জড়িত ছিল, তাই তারা সংখ্যালঘুদের দাবি পূরনের জন্য ২০০৮ সালে সংবিধানে পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতিও দেয়।  তবে সেই প্রতিশ্রুতি আর পূরন হয় নাই। ক্ষমতায় আসার পরে উলটো  তিনি সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা করেন এবং তাদের অত্যাচারকে সমর্থন দেন।

আরাকানের ঘটনাগুলোর মধ্যে [পরিবর্তিত নাম রাখাইন] এই দ্বন্দ্বগুলিই দেখতে পাওয়া যায়। আরাকান দেশের দক্ষিণে একটি ভৌগলিক অঞ্চল, যার অবস্থান বঙ্গোপসাগরের পূর্ব সমুদ্রতীর বরাবর ।  এখানে যে সমস্ত লোকেরা বাস করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হল রোহিঙ্গা, যারা সামরিক বাহিনীর দ্বারা নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছিল।  সরকার তিব্বতি-বার্মা আরাকানিজদের রাখাইন হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও মুসলিম রোহিঙ্গা জনগণদের স্বীকৃতি দেয় নাই। 

সামরিক বাহিনী আরাকান বিদ্রোহীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে হামলা করার আদেশটি এনএলডি প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসেছিল ২০১৯ সালের শুরুতে। আজকেই এই দলটিই আবার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আলোচনায় এসে গেছে।  সেই বছরও হামলার সময় রাজ্যের বেশিরভাগ অংশে ইন্টারনেট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে নভেম্বরের নির্বাচনে রাজ্যের প্রায় তিন চতুর্থাংশ ভোটারকে  বঞ্চিত করা হয়েছিল।  এই রাজ্যের লোকেরা কেন এনএলডিকে বিশ্বাস করে না তা যে কেউই সহজে বুঝতে পারবে!

এখন, মিলিটারিরা রাখাইনের জনগণের বন্ধু হওয়ার ভান করছে। যেখানে দেশের বাকি অংশে ইন্টারনেটে বিধিনিষেধ আরোপে করা হচ্ছে সেখানে ২ ফেব্রুয়ারি তারা রাখাইনে ইন্টারনেটের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়;  এবং তারপরে ১২ তারিখে বহু আরাকানি রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। 

এর ফলেই বুঝা যায় কেন এখনো বামারদের মধ্যে সুচির জনসমর্থন থাকলেও, সংখ্যালঘুদের মধ্যে নেই। তবে এটি খুবই  দুর্ভাগ্যজনক যে এখন সংখ্যালঘুদের অনেক তথাকথিত "নেতারা" সামরিক বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছেন। এরা স্রেফ সামরিক বাহিনীর স্বার্থে  ব্যবহৃত হবে এবং পরে তাদের পরিত্যাগ করা হবে।  যেমন সুচি আর তার দল এনএলডি তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তেমনি প্রয়োজন ফুরিয়ে ফেলে সামরিক বাহিনীও একই কাজ করবে। 

তবে এসবের মধ্যে অনেক ব্যতিক্রম আছে। সংখ্যালঘু নেতাদের অনেকে আছেন, যারা বুঝতে পারছেন যে নতুন সামরিক সরকার মায়ানমারের সমগ্র জনগনেরই শত্রু- বামার আর সংখ্যালঘু সবারই। তারা বুঝতে পারে যে সামরিক বাহিনী তাদের স্বার্থের জন্যই সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করছে। 

আসলে বিভিন্ন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার বর্তমান সামরিক সরকারের সহযোগিতায় বা সুচি কিংবা এনএলডি সমর্থনকারী উদারবাদী বুর্জোয়া শ্রেণীর মাধ্যমে আদায় করা সম্ভব না।  যা দরকার তা হল মিয়ানমার শ্রমিকদের একটি স্বতন্ত্র দল যার মূল স্লোগানগুলির একটি হবে: একটা ফেডারেশনের অধীনে সমস্ত মানুষের স্বাধিকার।   এটি অবশ্য পুঁজিবাদী সমাজে ঘটবে না, বরং এর জন্য প্রয়োজন  মায়ানমার সমাজতান্ত্রিক ফেডারেশন। 

 

আন্দোলনের গন্তব্য কী হতে পারে?

গণআন্দোলনের পরিধি বর্তমানে বেড়েই চলছে।  নাইপিডো, রেঙ্গুন, মান্দালয়, ম্যাগওয়ে এবং অন্যান্য শহরগুলিতে বিক্ষোভকারীদের দমনের জন্য তাদের উপর যে তান্ডব চালানো হয়েছে,  উল্টো তার বিপরীত প্রভাব পড়েছে। এতোকিছুর পরও  জনগন আন্দোলনে এগিয়ে যাচ্ছে।  সোজাভাবে বলতে গেলে শক্তির দিক দিয়ে এই আন্দোলনকে গুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা  সামরিক বাহিননীর ভালো করেই আছে।   তবে এটি নিছক সামরিক প্রশ্ন নয়।  এটি মূলত শ্রেণিশক্তিগুলো এবং নেতৃত্বের ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন।।

এখানে যেমনটি আমরা দেখেছি, শ্রমিকরা এই বিদ্রোহের প্রচারে মূল ভূমিকা পালন করেছিল।  দুর্ভাগ্যক্রমে, এই আন্দোলনেকে ঘিরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের এজেন্ডাও রয়েছে, তা হচ্ছে শুধুমাত্র সূচিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা।    কেউ কেউ সামরিক সরকারের সাথে "আলোচনার" চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন।  তবে কথায় আছে  "দূর্বলতা কেবল আগ্রাসনকেই  আমন্ত্রণ জানায়"। এখন যা প্রয়োজন তা হল প্রতিটি সেক্টর, প্রতিটি কর্মক্ষেত্রকে সাথে নিয়ে  আত্মপ্রতিরক্ষা দল গঠন করে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া, যার নেতৃত্ব  অবশ্যই বিভিন্ন  কর্মক্ষেত্র (যেমন কারখানা, ব্যাংক) এবং স্থানীয় এলাকাগুলোতে গঠিত কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে।

এর সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিতভাবে  স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় দখলের আহ্বান জানানো উচিত এবং কৃষকদেরও আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো উচিত।  এই আন্দোলনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতিদের কাছেও একটি স্পষ্ট বার্তা প্রেরণ করা দরকার যে এই আন্দোলন তাদের দাবি-দাওয়াকে বিবেচনা করে এবং তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

তবে এখানের সমস্যাটি হলো, আন্দোলনের ঘোষিত কেন্দ্রীয় লক্ষ্য সুচিকে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। এই আন্দোলন সুচির শ্রেণিচরিত্রটি ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।  তিনি মিয়ানমারের জনগণের স্বার্থ নয়, বৈশ্বিক পুঁজির স্বার্থকেই উপস্থাপন করেন।  মায়ানমারের জনগণ যে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে, তা বুঝাই যায়।তবে মার্কসবাদীরাও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় সোচ্চার।  আমরা বাক স্বাধীনতার অধিকার, ধর্মঘটের অধিকার, এবং আরও অনেক কিছুর জন্য ট্রেড ইউনিয়ন ও দল উভয়ই সংগঠিত করার অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছি।  মার্কসবাদীরা  অবশ্যই সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে, তবে তাইলে বলে আমরা কি এনএলডি এবং সূচিকে সমর্থন করতে পারি?  আমরা এখানেই লিবারাল বুর্জোয়া শ্রেণীর থেকে আলাদা।   আমরা যেমন শ্রমিক শ্রেণির স্বাধীন সংগঠনের পক্ষে আর  সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে তেমনি উদীয়মান বুর্জোয়া উদারপন্থীদেরও বিরোধীতা করি। 

 যদি সুচি সফলভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসে তবে সে তার আগের অবস্থানেই ফিরে আসবে।  তিনি সংখ্যালঘুগোষ্ঠীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন, তেমনি তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারদের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করবেন।  তিনি মিয়ানমারের শ্রমিক ও যুবকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবেন না, বরং পুঁজিবাদী শ্রেণীর স্বার্থেই কাজ করবেন।  সুচি এবং এনএলডির  বিকল্প একটি শ্রমিকশ্রেণীর দল জরুরিভাবে তৈরি করা দরকার। 

মায়ানমারে যা আছে তা হলো শ্রেণিবিন্যাসের একটি প্রক্রিয়া, যা কেবলমাত্র এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।  সেক্ষেত্রে সেখানে এখন পর্যন্ত শ্রমিকশ্রেণির একটি বিপ্লবী নেতৃত্ব নেই। তবে আন্দোলনের নেতারা  আর মাঠপর্যায়ের শ্রমিকরা সাধারণভাবে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। যদিও এই সমস্তকিছুকে একসাথে যুক্ত করে তাকে  একটি রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর করার মতো কোনো দল নেই।

আন্দোলনে শ্রমিকরা নিজ থেকে ধর্মঘটের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, অন্যান্য আন্দোলনকারীদের সাথে একত্রিত হয়েছেন, এটাই প্রমাণ করে যে তাদের মধ্যে সঠিক প্রেরণা এবং বোঝাপড়া আছে।  অনেকের চিন্তার  বিপরীতে শ্রমিকরা একটি উন্নত চেতনা প্রকাশ করছে।  তবে সমস্যাটি হল সরকারী ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা, তারা যখন বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন- তারা সাধারণত সুচি এবং এনএলডির সাথেই দাঁড়িয়ে আছেন, ফলে শ্রমিকদের একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর উত্থিত হতে পারছে না।

কিছু ইউনিয়ন নেতা রয়েছেন যারা তাদের প্রতিবাদী অবস্থান নিয়েছেন, তবে ইউনিয়নগুলি সাধারণত সংস্কারবাদী নেতাদের সাথে আঁতাত করেছে, তারা আইএলওর সমর্থনকৃত  অনেকগুলি এনজিও  দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, যাদের উদ্দেশ্য ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যদের আন্দোলনকে দূর্বল করে দিয়ে শ্রেণী আপোষের পক্ষে প্রচারণা চালানো।  পুঁজিবাদী শ্রেণি বুঝতে পেরেছে যে জনগণকে নিছক সামরিক উপায়ে দাবায়ে রাখা যায় না। এইক্ষেত্রে  শ্রমিক নেতাদের সাথে আঁতাত করলেই আন্দোলনকে দূর্বল করে দেওয়া যায়। যার কারণে শ্রমিক নেতারা বুর্জোয়া লিবারেকদের কাতারে এসেই দাড়িয়েছে।

স্বতন্ত্র শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে- মন্দের ভালোকেও না বলা

 

শ্রমিকরা তৃণমূল থেকে লড়াইয়ের জন্য ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করছে, এর থেকেই বুঝা যায় নেতারা কেন একশন নেওয়ার জন্য চাপের সম্মুখীন হচ্ছে৷ কিন্তু নেতারা এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছে যা আন্দোলনকে দূর্বল করে দেয়৷ তারা জোট বাঁধছে এনএলডির সাথে, শ্রমিকদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বুর্জোয়াদের সাথে, যার মানে ফলো পুঁজিবাদের একটি অংশকেই সহযোগীতা করা। 

রাজনৈতিকভাবে শূন্যতাটি পূরণ হয়েছে ত সূচি আর এনএলডিই পূরণ করেছে।  আন্দোলনের বোঝাপড়ার মধ্যে এই ব্যাপারগুলো আলাদা করা একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।  এই মুহুর্তে, জনগণের চিন্তায় যে ধারণাটি প্রাধান্য পেয়েছে তা হল আমাদের অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে দিয়ে গণতন্ত্রকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।  তারা অভ্যুত্থানের বিরোধিরা কতটা শক্তিশালী তা দেখাতে চান এবং আশাবাদী যে সামরিক বাহিনী তাতে সাড়া দেবেন এবং সামরিক শাসন প্রত্যাহার করবে।  মার্কসবাদীরা জনগনের এই চেতনার সাথে অবশ্যই সহানুভূতি প্রকাশ করে, তবে সাথে সাথে আমরা এও বলি যে এটিই যথেষ্ট নয়।

সামরিক বাহিনীকে যা চাপে ফেলনে  তা হল একটি গণআন্দোলনের বিকাশ যা এতটাই শক্তিশালী এবং বিস্তৃত যে এটি কেবল সামরিক শাসন ব্যবস্থাকে নয়, উচ্চতর স্তরেও আঘাত হানতে পারবে এবং পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে হুমকির সম্মুখীন করবে।  তাহলে ক্ষমতাসীন অভিজাতদের মধ্যে আরও কিছু বুদ্ধিমান কৌশলবিদ বুঝতে বাধ্য হবে যে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে পাঠানো এবং জনসাধারণকে শান্ত করার প্রয়াসে আবার সূচিকে ফিরিয়ে আনাই ভাল।

ন্যাশনাল এন্ডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির সহায়তায় ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি-মায়ানমার - ( যা মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল) - এবং অন্যান্য বিখ্যাত লোকজন, জাতিসংঘের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদকের নাতি এবং হার্ভার্ডের প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদ, থান্ট মাইন্ট-ইউ এবং অন্যান্যরা কিছু লোক এই লাইনেই পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষপাতী।  ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি প্রথমে একটি বিবৃতি জারি করেছিল যাতে "... অভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট সমস্ত সঙ্কট নিরসনে মূল শক্তিগুলোর সাথে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য জান্তার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।"  ক্ষমতাসীন অভিজাতদের মধ্যে আরও কিছু বুদ্ধিমান কৌশুলীরা বুঝতে পারেন যে জনগণের সরাসরি রাস্তায় নেমে আসা আর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া খিন বিপক্কনক, কেননা একবার কোনো জন আন্দোলন তৈরি মানুষ তাদের শক্তি কতটা সেটাও বুঝে যাবে।   কথায় আছে, 'যত খাই ততো বাড়ে ক্ষুধা',  পুঁজিবাদের কৌশুলীরা এখন আর সাম্রাজ্যবাদের অংশীদারীরা এখন এই ব্যাপারটিই নিয়েই চিন্তিত। তাদের মূল লক্ষ্য হল  আলোচনার টোপ দিয়ে জনসাধারণকে আবার "স্বাভাবিকতায়' ফিরিয়ে আনা, যেখানে তারা রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে।

শ্রমিক ও যুবকদের একটি স্বাধীন আন্দোলন এমন একটি বিষয় যা শুধু জেনারেলরা ভয় পান না,  সূচি আর এনএলডিও ভয় পায়।  আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে অফিসে থাকাকালীন সূচি জেনারেলদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন;  তিনি তাদের থেকে সংবিধান এবং সুবিধা অধিকার গ্রহণ করেছেন।  কারণ সামরিক বাহিনী দেশের একটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি,  জান্তা নিজেরাই পুঁজিবাদী।  তাদের ক্ষমতা থেকে সরানোর একমাত্র মোক্ষম উপায় হল তাদের অর্থনৈতিক শক্তিকে উচ্ছেদ করা এবং এর অর্থ হবে সামরিক মালিকানাধীন সমস্ত সংস্থার বাজেয়াপ্তকরণ।

বুর্জোয়া লিবারেলদের সমস্যা কোথায় সেটা দেখা যাক।  প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকদের একত্রিত করার মাধ্যমেই সামরিক পুঁজিপতিদের উচ্ছেদের মতো জাতীয় নেওয়া যেতে পারে এবং যদি সামরিক বাহিনীর অর্থনৈতিক শক্তিকে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য শ্রমিকরা জেগে উঠে, তবে এটি পুরো অর্থনীতির অর্ধেক অংশকেই প্রভাবিত করবে।  তবে যদি শ্রমিক আন্দোলন সামরিক বাহিনীকে উচ্ছেদ করার জন্য সংঘবদ্ধ হয়, তবে এটি শুধু সেখানেই থামবে না, বরং সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদকেও চ্যালেঞ্জ জানাবে।  এর সূত্র ধরেই  সূচি, এনএলডি আর সামরিক বাহিনীর আঁতাতটি বুঝা যায়। 

বর্তমান আন্দোলনের চরিত্র স্বতঃস্ফূর্ত।  বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রতি জনসাধারণের এখনও বড় ভ্রমের মধ্যে আছে।  তবে জনগণের জন্য গণতন্ত্র কোনো ফাঁপা ব্যবস্থা নয়, বরং এই অন্যায়-অবিচার শেষ করার উপায়, যা তাদের জীবনযাত্রার উন্নতি করা, অধিক মজুরি ও স্বচ্ছল জীবন, আরো বেশি কর্মসংস্থান, উন্নত ও সার্বজনীন শিক্ষা এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবার প্রতিশ্রুতি দেয়।    

বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আওতায় আপনি সংগঠিত হতে পারেন, শ্রমিক ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন থাকতে পারে, আপনার মতামত প্রকাশ করতে এবং আপনার দাবি সামনে তুলে ধরতে পারেন। আর  জনগণ সামরিক শাসনকে ভুলেতে পারেনি।  তারা জেনারেলদেরকেই প্রধান শত্রু হিসাবে দেখে।  এর অর্থ তারা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য, এমনকি তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদ করতে প্রস্তুত।  সে কারণেই সাধারণ মানুষ এখনো সূচিকে সমর্থন করে।  এবং এটিই ব্যাখ্যা করে যে কেন তাকে কেন তাকে আবার ক্ষমতায়  ফিরিয়ে আনা হতে পারে, তার এই কর্তৃত্বকে ব্যবহার করে  গণ-আন্দোলন যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেটার ব্যবস্থা করা। 

জনতা শিখে  অভিজ্ঞতা থেকে। সূচির প্রতি তাদের যে মায়া আছে, তার ঠুনকো অবস্থাটিও একটা সময় পর তাদের সচেতন মনে ধরা দিবে।  যখন অর্থনীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এই ব্যবস্থাটিই চাকরী, আবাসন ইত্যাদি সরবরাহ করতে পারে তখন জনগন দুর্নীতি ও  অবৈধ উপায়ে সুযোগ সুবিধা গ্রহণের ব্যাপারটিও সহ্য করতে পারে।  সূচি ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বছরগুলিতে একটা নিদৃষ্ট্র মাত্রা পর্যন্ত এই ব্যাপারগুলোই ঘটছিল।  কিন্তু যখন সিস্টেমটি আর একটা সভ্য জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম জিনিসপাতির সরবরাহ করতেও অক্ষম হয়, তখন জনগণ শীর্ষে থাকা লোকদের প্রশ্ন করা শুরু করে।  এই ঘটনাটিই একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘটবে এবং শ্রমিক এবং যুবকরা সূচির মধ্যে বুর্জোয়া লিবারেলদের এই ফাঁপা ব্যাপারটি দেখতে পাবে। 

যাই হোক, এই আন্দোলনের মধ্যে বিভিন্ন স্তর রয়েছে।  সেখানে 'সামরিক একনায়কতন্ত্রের পতন চাই, সূচির মুক্তি চাই'য়েএ মতো স্লোগানগুলো উচ্চারিত হচ্ছে৷ সাধারণ ভাবে দেখলে জনগণ এখনো এনএলডিকে নিয়ে ভ্রমে রয়েছে,  তারা এই দলকেই সরকারে দেখতে চায়। আবার আন্দোলনে আরেকটি বিকশিত অংশ আছে যারা ইতিমধ্যে সূচি এবং এনএলডির সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে পারছে। সেখানে অন্যান্য "২০০৮ এর সংবিধান বাতিল করুন;  ফেডারেল গণতন্ত্র গড়ে তুলুন ”- এরমতো স্লোগানও উচ্চারিত হচ্ছে, যা সরাসরি সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে যায় এবং সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীদের জন্য জায়গা করে দেয়।  এনএলডি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই ফাঁপা বুলিটিকে ধরতে পেরে তারা একেও অতিক্রম করে।।

এই পরিস্থিতিত অভিজ্ঞতাই সচেতন শ্রমিক এবং তরুণদের শিক্ষা দিচ্ছে যে বুর্জোয়া লিবারেলদের পথটি একদম শেষের দশায় গিয়ে ঠেকেছে ।তাদেরকে বলা হয়েছিলো  সেনাবাহিনীর তুলনায় সূচিকে 'মন্দের ভালো' হিসেবে দেখতে। তবে এই লড়াইয়ে  যা মাথায় রাখয়ে হবে তা হল গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করার অর্থ এই নয় যে কাউকে সূচির ফাদে পড়তে হবে।   আপনি সামরিক বাহিনীর সাথে লড়াই করতে পারবেন, একই সাথে বুর্জোয়া উদারপন্থীদের সমস্ত সীমাবদ্ধতার নিয়েও জনগণকে সতর্ক করে দিতে পারে।

মায়ানমারের গণআন্দোলনটি শুরু হয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য, তবে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিপ্লবটি শেষ পর্যন্ত জারি রাখতে হবে, যার অর্থ হচ্ছে  মায়ানমারে একটি সমাজতান্ত্রিক ফেডারেশনের গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংগ্রাম করা।   যা কাজ করবে সমস্ত অঞ্চলের সকল শ্রমিকের তরে।   আমরা ভারত এবং থাইল্যান্ডে বিশাল আন্দোলন দেখছি, যা সম্ভাবনা জাগায় মায়ানমারের শ্রমিকদের নেতৃত্বে এই আন্দোলনটির একটি বিশ্বব্যাপী রূপ দাঁড়ানোর। 

মোটকথা, যা প্রয়োজন তা হল এই  শাসন ব্যবস্থার  পতন ঘটানোর লক্ষ্যে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া।  এর অংশ হিসাবে, হরতাল কমিটিগুলোকে সমস্ত কর্মস্থল, পাড়া এবং গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন;  এবং এগুলোকে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয় করা।  এইভাবে আন্দোলনের একটি জাতীয় নেতৃত্ব থাকবে।  এর সাথে সাথে, কর্মস্থল এবং আশেপাশের এলাকায় সম্মিলিতভাবে স্ব-প্রতিরক্ষা দল তৈরি করা প্রয়োজন।

এখন দরকার জনগণের ইচ্ছার সত্যিকারের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে ২০০৮ সালের সংবিধানটি বাতিল করা এবং বিপ্লবী গণপরিষদ গড়ে তোলার চেষ্টা করা। অবশ্যই সেনা বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত আসন ছাড়া!  একই সময়ে, ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে সংগঠিত উপায়ে শ্রমিকদের জন্য একটি স্বাধীন পার্টি গড়ে তোলার জন্য সক্রিয় হওয়া।  তাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর ছাড়া, শ্রমিকরা সেইসন বুর্জোয়া উদারপন্থীদের দাবার ঘুটিতে পরিণত হতে বাধ্য হয়, যারা ক্ষমতায় ফিরে আসার সাথে সাথে তাদের সাথে পুনরায় বিশ্বাসঘাতকতা করবে।

মিয়ানমারের জনগণ, শ্রমিক, যুবক, কৃষক, জাতীয় সংখ্যালঘুরা যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তার মূল আসলে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের সঙ্কটে মধ্যেই রয়েছে।  আজ যে বিপ্লবী আন্দোলনটি চলছে তা কেবল গণতান্ত্রিক দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, বরং তাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং জনগণের  নিজস্ব দাবি উত্থাপন করতে হবে।  বর্তমান অচলাবস্থার সমাধান পুঁজিবাদী ভাবধারার ভিত্তিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।  যা দরকার তা হল বড় পুঁজিপতিদের, সামরিক অভিজাতদের, বিদেশী সংস্থাগুলির বাজেয়াপ্তকরণ এবং এগুলি শ্রমিকদের দ্বারা গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত করার ব্যবস্থা করা।