সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমেরে মধ্যে পার্থক্য কি?

গনমাধ্যম ও নানামূখী তথ্য আদান প্রদনের কারণে বহুলোকের  মাঝে এই শব্দ দুটি  ‘সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম’ সর্ম্পকে এর প্রতিষ্ঠাতা মহান কার্ল মার্কস এর উদ্দেশ্যের চেয়ে  ভিন্ন ধারণার জন্ম হয়েছে । এই দ্বিধাদ্বন্ধ সহজেই অনুমেয় যে, আধুনিক যুগে ও সেই তথাকতিত সমাজতন্ত্রী দল গুলো রাশিয়ায় ষ্ট্যালিনের একনায়তান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সাথে একাকার করে দেখেন । কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র (ইহাই মার্কসবাদের প্রকৃতশব্দ), এই শব্দটির সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে এবং ইহা  সুনির্দিষ্ট সমাজিক কাঠামোর নির্দেশনা দান করে । মার্কসবাদের সূত্রানুসারে উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যাক্তিগত মালিকানার মাধ্যমে পুঁিজবাদি পদ্বতীতে যে শোষন প্রক্রিয়া চলে তা থেকে শ্রেণীহীন সম্যবাদী সমাজে উত্তোরনের অর্ন্তবতীকালিন সময়কে সমাজতান্ত্রিক স্তর বলা হয়ে থাকে । সম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্র প্রচলিত অর্থে ব্যবহার হয়না, কার্যক্রমে ভয়ভীতি ও জাতীয় সীমারেখার অস্থিত্ব থাকে না ।

পুজিঁবাদী ব্যবস্থার অধীনে সমাজ ও রাষ্ট্র মাত্র কতিপয় ধনিব্যক্তির নেতৃত্বে পরিচলিত হয় । যারা শিল্প,কৃষি,পরিবহন ও অন্যান্য খাতের শ্রমিক শ্রেনীকে প্রতিনিয়ত শোষন করে সীমাহীন মুনাফা শিকার করছে । তারা জানেনই না যে সকল পণ্যের মাধ্যমে খাড়ি খাড়ি  মুনাফ লুটছেন তা কিভবে তৈরী হয় । তারা রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী,আইন, আদালত,কারাগার, সশস্র এলিট গ্র“প ও পুলিশ তৈরী করেছেন নিজেদের সুযোগ সুবিধা ও পদ ঠিক রাখার জন্য । সাম্যবাদের অধীনে সমাজ হবে সমগ্র সমাজের সামগ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রকৃত মালিক, সকলের প্রয়োজনে সবকিছুই ঊৎপাদন করা হবে সমাজের শান্তি ও স¤প্রীতির পরিবেশে । তবে এই দুইটির মধ্যে অর্ন্তবর্তীকালিন দুটি স্তর মানব সমাজ উন্নয়নের স্বার্থে সমাজতন্ত্রে পৌঁছার জন্য অতিক্রম করতেই হবে ।

যদি ও নৈরাজ্যবাদী অতি ঊৎসাহি ব্যাক্তিগণ মনে করেন  আমরা খুব রাতারাতি যাদুমন্ত্রের মত পুঁজিবাদ ও রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করে ফেলব ।  প্রাচুর্য্য ও স্বাধীনতার জন্য এবং সূখশান্তির এই নতুন যুগে প্রবেশের জন্য আমাদেরকে কি কি করতে হবে? সাম্যবাদের বস্তুগত বিষয়াবলী সকলের কাছে পর্যপ্ত পরিমানে পৌঁছে দিতে হবে । যত সময় পর্যন্ত আমরা প্রযুক্তি ও প্রকৌশলগত উন্নতি সাধন করতে না পারব, তত দিন পর্যন্ত দ্রুত দরিদ্র বিমোচন ও অভাব থেকে উল্লম্পনের মাধ্যমে মুক্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গ ভাবে পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণ ঘটাতে পারব না । মার্কসবাদীদেরে জন্য এই সময়টাকেই বলাহয় সমাজতন্ত্র । গোথা কর্মসূচির সমালোচনায় মার্কস এভাবেই তা ব্যাখ্যা করেছেন । পুঁজিবাদী সমাজ ও সমাজতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে একটি অনর্তবর্তী কালিন বিপ্লবী সময় অতিক্রম করতেই হবে । পারস্পরিক সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজনে অর্ন্তবর্তী কালিন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ভিতর দিয়ে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি সাধন করে বিপ্লবী প্রলেটােিয়টের একনায়কত্ব পতিষ্ঠা করতে হবে ।

এই প্রক্রিয়ার প্রাথমিক কাজ হিসাবে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শ্রমিক শ্রেণীর মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখল করতে হবে । যাকে মার্কসীয় পরিভাষায় বলাহয় ‘শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব’  যা ‘ধনিকশ্রেণীর একনায়কত্বের’ বিপরিত । যার অধীনে আমরা বর্তমানে বসবাস করছি । যখনই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখলের পরেই শ্রমিক শ্রেনী উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রন ভার গ্রহন করবে  এবং অংশগ্রহন মূলক পন্থায় কতিপয় ধনিক শ্রেনীর মানুষের স্বার্থের পরিবর্তে সকলের স্বার্থে তা পরিচালনা করবে । তখনই আমরা অতিদ্রুত সমাজের সকল মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পুরন করে আরো বেশী কিছু দিতে পারব । আমরা নির্মূল করব বেকারত্ব, দিতে পারব বিনামূল্যে  প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা, এ্যাডুকেশন, গৃহ সহ দরকারী সব কিছু সকলের জন্য । মানবের সকল সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটবে, মানুষ হয়ে উঠবে সৃষ্টিশীল বৃদ্ধিপাবে তাদের উৎপাদন শক্তির ।

মহান এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক ‘রাষ্ট্রের’ ব্যাখ্যায় বলেছেন, “ইহা সত্যিকার অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বশীল একটি সমাজ হবে, এই শব্দটি তার প্রচলিত অর্থের তাৎপর্যই হারিয়ে ফেলবে, রাষ্ট্র বিলিন হবে সমাজের মাঝে । পুঁজিবাদীরাষ্ট্রে সমাজের খুবই স্বল্প মানুষের প্রতিনিধিত্বই করে থাকে । আর সে জন্যেই তারা বেশীর ভাগ মানুষের উপর প্রভূত্ব ঠিকিয়ে রাখার জন্য নিমর্ম পন্থার আশ্রয় নিয়ে থাকে । তবে যদি একবার সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন সকলের স্বর্থে শুরু হয়ে যায় তবে দ্রুত পুলিশ ও সেনাবাহিনী বিলুপ হতে থাকবে এবং এর সাথে সাথে পুঁজিবাদি সমাজে চলমান শোষন, নিপিড়ণও বৈশম্য ক্রমান্নয়ে তিরোহিত হয়ে যাবে । এ ছাড়া পুঁজিবাদি সমাজে প্রচলিত ভয়ভীতি প্রদর্শন,শক্তি প্রয়োগ থাকবে না, সমগ্র সমাজব্যবস্থাটাই পরিচালিত হবে গনতান্ত্রিক ও অংশগ্রহনমূলক পদ্ধতিতে সকলের স্বার্থে সকলের প্রয়েজনে” ।

মহান লেনিনের “রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইয়ে বলা আছে, “ কেবলমাত্র সাম্যবাদী সমাজেই,যখন পুজিবাদী সমাজের বিলুপ্তি ঘটবে, যখন কোন শ্রেণী বৈশম্য থাকবেনা (যেমন সমাজে আর্থিক কারনে সামাজিক শ্রেণীভেদ থাকবেনা ), কেবল মাত্র তখনই রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটির বিলুপ্তি ঘটবে এবং তখনই মানুষ সত্যিকার বাক স্বাধীনতা, আর কেবল তখনই সত্যিকার পরিপূর্ণ গনতন্ত্রের স্বাদ পবেন সমাজের সকল নাগরিক..” ।

ভ.ই.লেনিন “রাষ্ট্র ও বিপ্লব” বইয়ে দেখিয়েছেন, “কমিউনিজমের দিকে বিকাশ এগোয় প্রলেতারীয় একনায়কত্বের মধ্য দিয়ে, অন্যভাবে এগুনো যায় না, কেননা, শোষক পুঁজিবাদীদের প্রতিরোধ চুর্ণ করার মতো আর কেউ নেই এবং অন্য পথ অসম্ভব।

এবং প্রলেতারীয় একনায়কত্ব, অর্থাৎ উৎপীড়কদের দমনের জন্য শাসক শ্রেণী রূপে উৎপীড়িতদের অগ্রবাহিনীর সংগঠন স্রেফ কেবল গণতন্ত্রের প্রসার ঘটাবে, তা হতে পারে না। গণতান্ত্রিকতার বিপুল প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে, এই সর্বপ্রথম যে গণতান্ত্রিকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ধনীদের জন্য নয়, গরিবদের জন্য, জনগণের জন্য গণতান্ত্রিকতা, তার সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারীয় একনায়কত্ব নিপীড়ক, শোষক ও পুঁজিপতিদের স্বাধীনতার উপর একগুচ্ছ বাধানিষেধ চাপায়। মজুরি-দাসত্ব থেকে মানবজাতির মুক্তির জন্য তাদের দমন করতেই হবে,তাদের প্রতিরোধ চূর্ণ করতে হবে বলপ্রয়োগেএকথা পরিষ্কার যে, যেখানে দমন রয়েছে, বলপ্রয়োগ রয়েছে সেখানে স্বাধীনতা নেই,গণতন্ত্র নেই।

... জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য গণতন্ত্র এবং জনগণের শোষক ও নিপীড়কদের বলপ্রয়োগে দমন অর্থাৎ গণতন্ত্র থেকে বহিষ্কারগণতন্ত্রের এই রূপান্তরই ঘটে পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিজমে উৎক্রমণের সময়।”

ভ.ই.লেনিন লিখেছেন, “...মার্কসের রাষ্ট্র বিষয়ক মতবাদের মর্মার্থ কেবল সে-ই আয়ত্ত করেছে যে বোঝে যে, একটি শ্রেণীর একনায়কত্ব কেবল সাধারণভাবে সমস্ত    শ্রেণী-সমাজের জন্য, কেবল বুর্জোয়া উৎখাতকারী প্রলেতারিয়েতের জন্য দরকার, তাই নয়,পুঁজিবাদ এবং “শ্রেণীহীন সমাজ” কমিউনিজমের অন্তর্বর্তী সমগ্র ঐতিহাসিক পর্বটার জন্য তা দরকার। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের রূপ অসাধারণ বিচিত্র, কিন্তু তাদের মূলকথাটা এক ঃ এ সমস্ত রাষ্ট্রই কোনো না কোনো ভাবে, এবং শেষ বিচারে অবধারিতভাবেই বুর্জোয়া একনায়কত্ব। পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিজমে উৎক্রমণে অবশ্যই রাজনৈতিক রূপের বিপুল প্রাচুর্য ও বৈচিত্র না দেখা দিয়ে পারে না, কিন্তু তাদের মূলকথাটা থাকবে অনিবার্যভাবেই একটা ঃ প্রলেতারীয় একনায়কত্ব।” (ঐ)।

প্রলেতারীয় একনায়কত্ব প্রসঙ্গে ভ.ই. লেনিন আরও দেখিয়েছেন, “প্রলেতারীয় একনায়কত্বের অর্থ কেবল শোষকদের ওপর বলপ্রয়োগ মাত্র নয়, এমনকি প্রধানত বলপ্রয়োগও নয়। এই বৈপ্লবিক বলপ্রয়োগের অর্থনৈতিক ভিত্তি, তার প্রাণশক্তি ও সাফল্যের গ্যারান্টি হল এই যে প্রলেতারিয়েত পুঁজিবাদের তুলনায় একটা উচ্চতর ধরনের সামাজিক শ্রমব্যবস্থার মুখপাত্র ও তা কার্যকর করে। এই হল আসল কথা। কমিউনিজমের অনিবার্য পূর্ণ বিজয়ের উৎস, শক্তি ও গ্যারান্টি এইখানে।”

ভ.ই.লেনিন লিখেছেন, “মার্কসবাদী ও নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে তফাৎ এই যে ঃ (১) প্রথমোক্তরা রাষ্ট্রের পূর্ণ বিলুপ্তির ল্য নিলেও স্বীকার করে যে, সে ল্য কার্যকরী হওয়া সম্ভব কেবল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কর্তৃক শ্রেণী-বিলোপের পরে, রাষ্ট্র শুকিয়ে মরার দিকে আগুয়ান সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফল হিসেবে; শেষোক্তরা রাতারাতি রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ বিলোপ চায়, সেরূপ বিলুপ্তি কার্যকরী করার শর্ত বোঝে না। (২) প্রথমোক্তরা স্বীকার করে যে, প্রলেতারিয়েতের পে রাজনৈতিক মতা জয় করার পর সাবেকী রাষ্ট্রযন্ত্রটা পুরোপুরি ভেঙ্গে তার স্থলে প্যারিস কমিউন ধরণে সশস্ত্র শ্রমিকদের সংগঠন বসানো দরকার; দ্বিতীয়োক্তরা রাষ্ট্র যন্ত্র ধ্বংস সমর্থন করলেও তার স্থলে প্রলেতারিয়েত কী বসাবে এবং কিভাবে বিপ্লবী মতা সে কাজে লাগাবে সে ধারণা তাদের একেবারেই অস্পষ্ট; নৈরাজ্যবাদীরা এমনকি বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাষ্ট্রমতা ব্যবহারে, তার বিপ্লবী একনায়কত্বেও আপত্তি করে। (৩) প্রথমোক্তরা আধুনিক রাষ্ট্র কাজে লাগিয়ে প্রলেতারিয়েতকে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করার দাবি করে; নৈরাজ্যবাদীরা তার বিরোধী।” (রাষ্ট্্র ও বিপ্লব)।

ভ.ই.লেনিন যথার্থই লিখেছেন, “পুঁজিবাদী সমাজে আমরা পাই কাটাছেঁড়া, হতচ্ছাড়া, জালকরা একটা গণতন্ত্র, যা কেবল ধনীদের জন্য,অল্পাংশের জন্য। প্রলেতারীয় একনায়কত্ব, কমিউনিজমে উৎক্রমণের পর্বটাই প্রথম দেবে শোষকদের উপর সংখ্যাল্পদের আবশ্যকীয় দমনের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের জন্য, অধিকাংশের জন্য গণতন্ত্র। কেবল কমিউনিজমই দিতে পারে সত্য সত্যই পরিপূর্ণ গণতন্ত্র, এবং সে গণতন্ত্র যতই পরিপূর্ণ হবে, ততই দ্রুত তা নি®প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াবে, আপনা থেকেই শুকিয়ে মরবে।

অন্য কথায় ঃ পুঁজিবাদে আমরা পাই সঠিক অর্থে একটি রাষ্ট্র, এক শ্রেণী কর্তৃক অপর শ্রেণীকে, তদুপরি সংখ্যাল্প কর্তৃক সংখ্যাগুরুদের দমনের একটা বিশেষ যন্ত্র। বোঝাই যায় যে, সংখ্যাল্প শোষক কর্তৃক সংখ্যাগুরু শোষিতদের নিয়মিত দমনের মতো একটা ব্যাপার সফল হতে হলে দরকার দমনের চূড়ান্ত হিংস্রতা ও পাশবিকতা, দরকার রক্তের একটা সমুদ্র, মানবজাতিকে যেখানে খুঁড়িয়ে চলতে হয় দাসত্বে, ভূমিদাসত্বে, মজুরি দাসত্বে।

তারপর, পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিজমে উৎক্রমণের সময় দমন তখনো দরকার, তবে সেটা অধিকাংশ শোষিত কর্তৃক অল্পাংশ শোষকদের দমন। বিশেষ হাতিয়ার, দমনের বিশেষ যন্ত্র হিসেবে ‘রাষ্ট্র’ তখনো দরকার, কিন্তু সেটা তখন উৎক্রমায়মান রাষ্ট্র, সঠিক অর্থে সেটা আর তখন রাষ্ট্র নয়, কেননা দাস, ভূমিদাস, মজুরি-দাসদের বিদ্রোহ দমনের তুলনায় গতকালের মজুরি-দাসদের অধিকাংশ কর্তৃক শোষকদের অল্পাংশকে দমন করার কাজটা এতই সহজ, সাধারণ ও স্বাভাবিক যে, মানবজাতিকে তার জন্য অনেক কম মূল্য দিতে হবে। এবং তাতে জনসংখ্যার এতই বিপুল একটা সংখ্যাগরিষ্ঠের নিকট গণতন্ত্রের স¤প্রসারণ চলে যে দমনের বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন লোপ পেতে শুরু করে। খুবই স্বাভাবিক যে, শোষকেরা এরূপ কাজের জন্য জটিলতম যন্ত্র ছাড়া জনগণকে দমন করতে অম, কিন্তু জনগণ শোষকদের দমন করতে পারে অত্যন্ত সরল ‘যন্ত্রের’ সাহায্যেই, প্রায় ‘যন্ত্র’ ছাড়াই, বিশেষ হাতিয়ার ছাড়াইনিতান্তই সশস্ত্র জনগণের সংগঠন দিয়েই (একটু এগিয়ে বলি, যেমন শ্রমিক-সৈনিক প্রতিনিধি সোভিয়েত)।

শেষত, রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ নি®প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় কেবল কমিউনিজমে, কেননা, তখন দমন করার মতো কেউ থাকছে না‘কেউ’,এটা অবশ্য শ্রেণীর অর্থে, জনগণের নির্দিষ্ট একটা অংশের সঙ্গে প্রণালীবদ্ধ সংগ্রামের অর্থে। আমরা মোটেই ইউটোপীয় নই এবং ব্যক্তি বিশেষের অনাচার তা সেরূপ অনাচার দমনের আবশ্যিকতা যে আছে এ সম্ভাবনা এবং অনিবার্যতা আমরা এতটুকু অস্বীকার করি না। কিন্তু প্রথমত, তার জন্য দমনের বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন নেই, সশস্ত্র জনগণ নিজেরাই সে কাজটা তেমনি সহজে ও অনায়াসে করবে যেভাবে এমনকি বর্তমান সমাজেই সুসভ্য জনতা মারপিট ছাড়িয়ে দেয় কিংবা নারীর ওপর বলাৎকার হতে দেয় না।দ্বিতীয়ত, আমরা জানি যে, সমাজ জীবনের নিয়ম লঙ্ঘন করা অনাচারের মূল কারণ হল জনগণের উপর শোষণ, তাদের অভাব-অনটন। অনাচারের এই প্রধান কারণটা দূর হলেই অনাচারও অনিবার্যভাবেই ‘শুকিয়ে মরতে’ শুরু করবে। সেটা কত তাড়াতাড়ি ও কী ক্রমিকতায় হবে সেটা আমরা জানি না, কিন্তু এটা আমরা জানি যে, ওগুলো শুকিয়ে মরবে। তারা শুকিয়ে মরার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রও শুকিয়ে মরবে।” (রাষ্ট্র ও বিপ্লব)।

তিনি লিখেছেন, “গণতন্ত্র হল রাষ্ট্রের একটি রূপ, তার রকমফেরের একটি। সুতরাং সমস্ত রাষ্ট্রের মতোই তা হল লোকের উপর সংগঠিত প্রণালীবদ্ধ বলপ্রয়োগ। এটা একটা দিক। কিন্তু অন্যদিক থেকে গণতন্ত্রের অর্থ  নাগরিকদের মধ্যে সমতা, রাষ্ট্র-কাঠামো নির্ণয়ে ও তা পরিচালনায় সকলের সমান অধিকারের বাহ্যিক স্বীকৃতি। সেটার সঙ্গে আবার এই ব্যাপারটা জড়িত যে, গণতন্ত্রের বিকাশের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে তা প্রথমত, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী শ্রেণী প্রলেতারিয়েতকে একীভূত করে এবং বুর্জোয়া,এমনকি     প্রজাতান্ত্রিক-বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র, স্থায়ী ফৌজ, পুলিশ, আমলাতন্ত্রকে ভাঙা, চূর্ণ বিচূর্ণ করা, দুনিয়া থেকে মুছে দেবার সুযোগ তাকে দেয়, এমন একাটা জিনিস স্থলাভিষিক্ত করার সুযোগ দেয় যা আরো বেশি গণতান্ত্রিক, কিন্তু মিলিশিয়ায় জনগণের প্রত্যেকের অংশগ্রহণের দিকে এগিয়ে যাওয়া সশস্ত্র শ্রমিকগণের আকৃতিতে তা তখনো রাষ্ট্রযন্ত্রই।” (ঐ)

ভ.ই.লেনিন আরও লিখেছেন, “কমিউনিজমের ‘উচ্চ’ পর্যায় যতদিন না শুরু হচ্ছে ততদিন সমাজতন্ত্রীরা সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়ের প থেকেই শ্রমের মাপ ও উপভোগের মাপের ওপর কঠোরতম নিয়ন্ত্রণ দাবি করে, শুধু সে নিয়ন্ত্রণ শুরু করা চাই পুঁজিপতিদের উচ্ছেদ দিয়ে, পুঁজিপতিদের ওপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে এবং তা চালু করবে রাজপুরুষেরা নয় সশস্ত্র শ্রমিকদের রাষ্ট্র।” (ঐ)

ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান করে সার্বজনীন ভূমি, সার্বজনীন কলকারখানা ও সার্বজনীন শ্রমের কথা বলতেই বুর্জোয়া তথা ধনিক শ্রেণী ও তাদের অনুসারীরা স্বাধীনতা গেল, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য গেল, ন্যায় গেল বলে চিৎকার জুড়ে দেয়। অথচ আমরা প্রত্য করছি যে,বর্তমান সমাজের শতকরা নব্বই জনই পরাধীন তথা বুর্জোয়াদের অধীন, প্রকৃত অর্থে না আছে তাদের কোন স্বাধীনতা না আছে স্বাতন্ত্র্যবোধ। তবে এ সমাজে তাদের না খেয়ে থাকার স্বাধীনতা আছে। সে-সঙ্গে প্রতিদিন একবেলা বা আধাবেলা খেয়ে থাকার স্বাধীনতা আছে। বিনা চিকিৎসায় মরার স্বাধীনতা আছে। কারণ, মালিক শ্রেণীর মুখাপেী করে তোলা হয়েছে শতকরা নব্বই ভাগ মানুষকে। এদের মধ্যেই পড়ে শ্রমিক শ্রেণী সহ মেহনতী জনগণ।

বিশ্বব্যাপী বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাদের যে শিা দেয় তা হল, “যে পরিমাণে বুর্জোয়া শ্রেণী অর্থাৎ পুঁজি বেড়ে চলে ঠিক সেই অনুপাতে বিকাশ পায় প্রলেতারিয়েত অর্থাৎ আধুনিক শ্রমিক শ্রেণী, মেহনতীদের এ শ্রেণীটি বাঁচতে পারে যতণ কাজ জোটে, আর কাজ জোটে শুধু ততণ যতণ তাদের পরিশ্রমে পুঁজি বাড়তে থাকে। এই মেহনতীদের নিজেদের টুকরো টুকরো করে বেচতে হয়। বাণিজ্যের অন্য সামগ্রীর মতোই তারা পণ্যদ্রব্যের সামিল। আর সেই হেতু নিয়তই প্রতিযোগিতার সবকিছু ঝড় ঝাপটা, বাজারের ওঠানামার অধীন তারা।” (কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার)।

তাই যখন জিজ্ঞাসা করা হয় আমরা কারা তখন আমরা বলি আমরা ঊভয়ই অর্থাৎ আমরা সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী ।  আমরা লড়াই করছি সাম্যবাদেও জন্য । কিন্তু এর প্রাথমিক স্তও হলো গনতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র । তবে সবার উপরে আমাদেও পরিচয় হলো আমরা মার্কসবাদী ।

মহান র্কাল মার্কসের চিন্তাধারা হলো কর্মেও নিদ্দের্শনা, যা আমাদেরকে সমাজ থেকে পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পথ দেখায় ..।