মে দিবসের চ্যালেঞ্জ !

মে দিবস হলো এমন একটি দিন যা সকল ধর্ম,বর্ণ, জাতি ও গৌষ্ঠির নিপিড়িত মানুষকে একই সমতলে দাঁড় করিয়ে দেয় । ইহা দুনিয়ার সবর্ত্রই সমভাবে সমাদৃত ও গৃহিত হয়েছে ।

এবার যখন মে দিবস পালিত হচ্ছে, তখন পুঁজিবাদী বিশ্বে চলছে চরম সংকট । যা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের জীবন যাত্রাকে এক সীমাহীন অনিশ্চিয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে । যদি ও ক্যানেশিয়ান উন্নয়ন মডেল ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে এক মহা বির্পযয় ডেকে আনছে, তবু ও মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে । চলমান বিশ্বে নির্বিচার সংস্কার, বেসরকারী করণ, অবাধ ছাটাই, চাকুরীচ্যুত করন, অর্থনীতির উদারিকরণ শ্রমজীবি মানুষকে দিনে দিনে এক কষ্ট কর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে । তুলনামূলক ভাবে বিগত দুই দশকের তুলনায় এখন শ্রমজীবি মানুষের মাঝে নিরবতা ভেঙ্গে জেগে উঠার ও শ্রেণী সংগ্রামের চেতনাকে শাণিত করার প্রবণতা পরিদৃষ্ট হচ্ছে, তারা জেগে উঠছে দাবী আদায় ও নতুন দুনিয়া গড়তে। মহান আরব বসন্ত, পৃথিবী ব্যাপী অকুপাই আন্দোলন, রাশিয়ার রাজ পথের গণ প্রতিবাদ ও পদ চারনা , চিনের আঞ্চলিক বিদ্রোহ ও কর্মবিরতি, গ্রিসের সাধারণ মহাধর্মঘট, স্পেন, ইটালী, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, ফ্রান্স, হাঙ্গেরী, রোমানিয়া, ব্রিটেন এবং ইউরূপের বাহিরে প্রতিটি মহাদেশে, ভারত থেকে চিলি ও ইজরায়েলের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিপবের নতুনভাবে সূচনা হয়েছে  ।

আজকাল পাড় সংস্কারবাদীরা ও একথা স্বীকার করছেন যে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পুঁজিবাদ এখন পতনের দারপ্রান্তে । অবাক করার মত বিষয় হলো, ব্রিটিশ মূলধারার একটি পত্রিকা ‘দি গাডিয়ান’  গত সপ্তাহে এই বলে মন্তব্য করে যে, “কমিউনিজম এখন কেবল মাত্র প্রতিবাদের ভাষা নয় ; বরং প্রচলিত ব্যবস্থার বিপরীতে এক জীবন্ত ও শক্তিশালী আদর্শ হিসাবে ফিরে আসছে ; সব কিছুকে চাপিয়ে নতুন ভাবে সংগঠিত হয়ে, নিয়ম তান্ত্রিকতা ও কঠোর পরিশ্রম...মহান কার্ল মার্ক্সের প্রাজ্ঞতা আজ ও প্রাসঙ্গীক বলে প্রতিভাত হচ্ছে । সম্ভবতঃ অতিতের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন আমরা অধিকতর স্বাধীন ও মুক্তভাবে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও পরাধীনতাকে সজ্ঞায়িত করতে পারি । আজ সময় এসেছে চলমান দ্বন্ধের ও প্রচলিত শব্দমালার সঠিক ব্যাখ্যা করার যেমন , ‘সন্ত্রস দমনের জন্য যুদ্ব’ , ‘গণতন্ত্র ও স্বাধিনতা,’ ‘মানবাধিকার,’ ইত্যাদী  হলো  প্রতারণাপূর্ণ  ও রহষ্যেভরা শব্দমালা, যা আমাদের প্রকৃত অবস্থা বুঝার পরিবর্তে ভাবনার জগৎকে আছন্ন করে রাখে । বুর্জোয়া গণমাধ্যমে তাদের নিষিদ্ধ শব্দ সমূহ নেতিবাচক ভাবে হলে ও আবার ফিরে আসছে ।

১লা মে, ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে শাহাদত বরনকারী শ্রমিকদের সম্মানে এই দিনটি বিশ্ব ব্যাপী পালন করা হয় । তারা সাদা পতাকা নিয়ে ৮ ঘন্টা কাজ করার দাবীতে মিছিল নিয়ে রাজ  পথে নেমেছিল । যখন তারা ‘হে মার্কেটে’ এর কাছে পৌছাঁয় তখন, পুলিশ তাদের উপর গুলি বর্ষন করলে সাদা পতাকা শ্রমজীবি মানুষের রক্তে ভিজে  লাল হয়ে উঠে । কিন্তু  এই দিনটির স্মরনে আর্ন্তজাতিকভাবে পালনের জন্য কোন সরকার বা তাদের কোন আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ গ্রহন করেনি । মাকর্সবাদের মহান পথ প্রদশর্ক ফ্রেডারিক এঙ্গেলস ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আর্ন্তজাতিকের কংগ্রেসে শ্রমিকশ্রেণীর আর্ন্তজাতিকতার প্রতিক হিসাবে এই দিনটি পালনের জন্য সিদ্ধান্ত আকারে ঘোষনা করেন । মে দিবস হলো এমন একটি দিন যা সকল ধর্ম,বর্ণ, জাতি ও গৌষ্ঠির নিপিড়িত মানুষকে একই সমতলে দাঁড় করিয়ে দেয় । ইহা দুনিয়ার সবর্ত্রই সমভাবে সমাদৃত হচ্ছে । শ্রমজীবি মানুষ কর্তৃক পৃথিবীর সবর্ত্র এই দিনটিকে পালনের জন্য  সর্বোত ভাবে গ্রহন করা হয় । ১৯০৪ সালে, মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে মহান লেনিন তাঁর এক নিবন্ধে লিখেন,“ শ্রমিক বন্ধুগণ ! মে দিবস আসছে,সকল দেশের শ্রমজীবি মানুষ ইহা পালন করবেন, তাদের জেগে উঠার ও আত্মসচেতন জীবন গড়ার প্রত্যয়ে, তারা একাত্মতা ঘোষনা করবেন সেই সংগ্রামের প্রতি যা অনাহার,দারিদ্রতা, অপমান নির্যাতন, নিপিড়ন  সহ সকল প্রকার জবর দস্তির অবসান ঘটাবে । সমাপ্ত হবে মানুষ কর্তৃক মানুষ শোষনের সকল প্রকার ব্যবস্থার । দুইটি বিশ্ব পরস্পর মূখোমূখী দাড়িঁয়ে আছে ; মহান এক লড়াইয়ে জন্য। পুঁিজবাদ বিশ্ব ও শ্রমিকশ্রেনীর বিশ্ব, শোষক শ্রেনীর ও দাসত্বের বিশ্ব এবং ভ্রাতৃত্বের ও স্বাধীনতার বিশ্ব ”। 

সে যাই হোক,দ্বিতীয় কমিউিনিষ্ট আর্ন্তজাতিকের  রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিচ্যুতি  ও মে দিবসের চেতনায় শ্রমিক শ্রেণীর আর্ন্তজাতিক মনোভঙ্গীতে  নেতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করে ।  তথাকথিত দেশপ্রেম ও সমাজ প্রেম শ্রমিক সংগঠন গুলোতে প্রভাব ফেলতে থাকে ; সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদ এবং স্যোসিয়াল ডেমোক্রেসির অনুসারীতে রূপান্তরিত হয়ে উঠে । প্যারিসের দ্বিতীয় কমিউনিষ্ট আর্ন্তজাতিকের মুলত মে দিবসের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা হয়েছিল । আর তা ছিল সকল দেশের শ্রমিক শ্রেণীর একই দিনে জেগে উঠার  ও জ্বলে  উঠার মধ্যদিয়ে সংগঠিত হয়ে একটি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা । আর ইহা তৈরী হবে ১৮৬৪ সালে মহান র্কাল মাকর্স ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কমিউনিষ্ট লীগের প্রথম আর্ন্তজাতিকের আলোকে । মার্কসীয় আর্ন্তজাতিকতা  গড়ে উঠে একবিশ্ব কেন্দ্রিক, যার রাজনৈতিক মতাদর্শ হলো সকল দেশ কাল, ধর্ম, বর্ণ, গৌত্র  নির্বিশেষে সকল বাধাঁ চিন্ন করে ঐক্য গড়ে তোলা যার মাধ্যমে শাসক শ্রেণী নিজেদের শোষন প্রক্রিয়াকে বহাল রাখে । ইহা হলো সমপূর্ণরূপে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠা সংগঠন । যেখানে থাকবে পর্যাপ্ত বির্তক ও গনতন্ত্রের চর্চা , এবং ঐক্য এবং কর্মের জন্য অবারিত সুযোগ ।  ইহা বিশ্ববাজার ব্যবস্থাকে নিমূর্ল করবে,  সমগ্র দুনিয়া হবে এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীন । এটা  হবে বিশ্ব রাজনৈতিক, কুটনৈতিক ও যুদ্ধাবস্থার অবসান  ঘটানোর সুবর্ণ সময় । তাই মানব জাতিকে দুঃখ, যন্ত্রনা, দারিদ্র, পুঁজিবাদের সৃষ্ট সীমাহীন দুর্ভোগ বিদুরিত করতে একটি বিশ্ব বিপ্লব একান্ত প্রয়োজনীয হয়ে পড়েছে ।

এ বছর ওয়ালষিট্রট অকুপাই আন্দোলনকে সমর্থন করে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৯০০ শত বড় শহরে শ্রকিক,তরুণ ও ছাত্রদের প্রতিবাদ সমাবেশ ও সংর্ঘষ কোন নিচক দূর্ঘটনা নয় । এটা বিশেষভাবে ভাবার বিষয় যে, পুজিঁবাদী দুনিয়ার বড় বড় শহরেই  এই সকল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে , আমেরিকাতেই এর তিব্রতা ছিল সব ছেয়ে বেশী ।  এই আন্দোলন বিশ্বের মিলিয়ন মিলিয়ন শ্রমিক ও তরুণদেরকে প্রেরণা দিয়েছে ; এটা ছিল বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী একটি দেশের পেটের ভিতর নিপিড়িত মানুষের এক মহা বিদ্রোহ ও বিস্ফুরণ । এবারের মে দিবস পালিত হবে বিপ্লবী চেতনাকে শানিত করার মহান প্রত্যয় নিয়ে । শ্রমজীবি মানুষের জীবন মান দিনে দিনে চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে , পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে । মহান লেনিন লিখেছিলেন,“রাজনীতি হলো অর্থনীতির এক ঘনিভুত রূপ” । অর্থনৈতিক বাস্তবতা সাধারণ মানুষে কাছেই প্রথম প্রতিভাত হয়। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে শ্রেণী সংগ্রামের প্রতিক্রিয়া ব্যাপক ভাবে অনুভুত হচ্ছে । মে দিবসের চ্যালেঞ্জ আজ পরিষ্কার : আজ সকলেই বুঝতে পারছেন যে, “দুনিয়ার মজুরদেরকে ঐক্যব্ধ হতে হবে”।  পুঁিজবাদের আওতায় কিছু সংস্কারের মাধ্যমে সুন্দর জীবনের আশা করা বৃথা । মানব জাতির উচিত এখনই একে ছুড়েঁ ফেলা । যে কোন একটি দেশে এখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধন খুবই গুরুত্ব পূর্ণ হয়ে উঠবে,কারন ইহার প্রভাব দ্রুত সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, কেননা বিশ্ব এখন অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে একে অন্যের সাথে অধিকতর  আন্তঃসম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ ।