সাম্য সম্পর্কে একজন লিবারেল অধ্যাপকের আলাপ

I. Lenin, First Published in Pravda, 11 March, 1914

লিবারেল অধ্যাপক জনাব তুগান-বারানোভস্কি রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এবার তিনি সাম্যের প্রশ্নটিকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জায়গা থেকে নয়, বরং একটি বিমূর্ত জায়গা থেকে আলোচনা করে এগিয়েছেন (সম্ভবত তিনি ভাবছিলেন এমন একটি বিমূর্ত আলোচনা তার আশেপাশের ধর্মীয় এবং দার্শনিক পরিবেশের জন্য উপযুক্ত হবে, হয়ত সেকারনেই তিনি এই পন্থা অবলম্বন করেছেন?)

জনাব তুগান বারানোভস্কি তার আলাপে বলেন, “যদি আমরা সমাজতন্ত্রকে একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে না নিয়ে জীবনযাপনের আদর্শ হিসেবে দেখি, তাহলে নিঃসন্দেহে এটি সমতার আদর্শ ধারনার সাথে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু এটি শুধুমাত্র একটা ভাবনাই… যেটা অভিজ্ঞতা এবং যুক্তি দ্বারা নির্ণয় করা যায়না।”

এই হচ্ছে একজন লিবারেল পণ্ডিতের আলোচনার ঢং, যিনি খুবই গতানুতিক এবং মামুলী কিছু কমনসেন্স ব্যবহার করার মাধ্যমে বলে দিলেন যে, অভিজ্ঞতা এবং যুক্তি স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে সব মানুষ সমান নয়, কিন্তু তারপরেও সমাজতন্ত্র এর আদর্শ হিসেবে সমতাকেই বেছে নেয়। তাই, আপনি সমাজতন্ত্রকে পছন্দ করলেও এটি নিছক একটি অর্থহীন ধারনা যা অভিজ্ঞতা এবং যুক্তির বিপরীত, ইত্যাদি ইত্যাদি!

জনাব তুগান মূলত প্রতিক্রিয়াশীলদের পুরানা ভেলকিবাজির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন এখানেঃ প্রথমে সমাজতন্ত্রকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে এমন একটি বিষয়ে পরিণত করা যাতে করে এটিকে অযৌক্তিক মনে হয়, এবং তারপর সেই কল্পিত অযৌক্তিকতাকে বাতিল করে দিয়ে তর্কে জয়ী হওয়া! আমরা যখন বলি, অভিজ্ঞতা এবং যুক্তি এটাই প্রমান করে যে সব মানুষ সমান নয়, তখন এখানে সমান দ্বারা আমরা বুঝাচ্ছি দৈহিক এবং মানসিক শক্তি ও দক্ষতার দিক থেকে সমান নয়।

উপরোক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কোনও মানুষই সমান নয় এটি বলার অপেক্ষা রাখেনা। যেকোনও সচেতন মানুষ কিংবা যেকোনও সমাজতান্ত্রিকই এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু এই ধরনের সমতার সাথে সমাজতন্ত্রের কোনও সম্পর্ক নেই। যদি ধরেও নেই যে জনাব তুগানের চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে, অন্ততপক্ষে তার পড়ার শক্তিতো লোপ পায়নি; অন্তত তিনি যদি সমাজতন্ত্রের স্থপতি ফ্রেদরিখ এঙ্গেলসের বইও খুলে দেখতেন, যেখানে তিনি ড্যুরিংকে লক্ষ্য করে বিতর্ক করছেন এবং যুক্তি দিচ্ছিলেন। জনাব তুগান দেখতে পেতেন পুরো একটি আলাদা সেকশনই রয়েছে উক্ত বইতে, সেখানে এঙ্গেলস ব্যাখ্যা করছেন যে, অর্থনৈতিক সমতা বলতে শ্রেণীহীন সমাজ গঠন ছাড়া অন্য কোনওকিছু ভাবাটা হবে নিরর্থক এবং অযৌক্তিক। কিন্তু এরপরেও যখন তু্গানের মত অধ্যাপকেরা এরকম বালখিল্য আলাপ দিয়ে সমাজতন্ত্রকে খারিজ করে দিতে চায়, তখন একজন এটা ভেবেই কূলকিনারা পাবেনা যে তাদের কোন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসলে অবাক হওয়া যায়!- তাদের নির্বুদ্ধিতা, তাদের মূর্খতা, নাকি তাদের ভন্ডামি!

যেহেতু আমরা এখানে জনাব তুগানের লেখা নিয়ে আলাপ করছি, সুতরাং একেবারে আমাদের সাধারণ জ্ঞান থেকেই আলাপটা শুরু করা যাক।

রাজনৈতিক সমতা বলতে সমাজতান্ত্রিকরা সমান অধিকার বুঝায়, এবং অর্থনৈতিক সমতা বলতে কী বুঝায় তা ইতোমধ্যেই বলেছি একবার, অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজকে উচ্ছেদ করে শ্রেণীহীন সমাজ গঠন করা। দৈহিক এবং মানসিক দক্ষতার দিক থেকে সমতা প্রতিষ্ঠার কথা সমাজতান্ত্রিকেরা কল্পনাও করেনা।

রাজনৈতিক সমতা বলতে একটি রাষ্ট্রে নিদির্ষ্ট বয়সীমা থেকে শুরু করে প্রতিটি ব্যক্তি যাদের কোনওরকম মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা অধ্যাপকসুলভ বোকাচোদামির বাতিক নেই, তাদের সমান রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের দাবীকে বুঝানো হয়। কোনও সমাজতান্ত্রিক বা শ্রমজীবী শ্রেণীর কেউ নয়, বরং বুর্জোয়া শ্রেণীর লোকেরাই প্রথম এই দাবী সামনে এনেছিল। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাই এর প্রমাণ বহন করে, এবং জনাব তুগান যদি প্রথমেই “অভিজ্ঞতা”কে প্রাধান্য দিতেন তাহলে তিনিও এটি বুঝতে পারতেন, কিন্তু এটি তার এজেন্ডা নয় কোনওভাবেই, তার এজেন্ডা খুবই স্পষ্ট, অভিজ্ঞতার ধোঁয়া তুলে ছাত্র এবং শ্রমিকদের ধোঁকা দিয়ে সমাজতন্ত্র “খারিজ” করে শাসকগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করা।

মধ্যযুগীয় সামন্তশাসক, সার্ফমালিক এবং জাতপ্রথা ভিত্তিক বিশেষ সুবিধা ভোগের ব্যপারটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই বুর্জোয়া শ্রেণী প্রথম এই সমানাধিকারের দাবী তোলে। যেমন, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড এবং অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর থেকে এই ব্যাপারে আলাদা রাশিয়া। কারন রাশিয়াতে অভিজাত শ্রেণী এখনও রাজনৈতিক জীবনের সবক্ষেত্রেই বাকিদের তুলনায় অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করে থাকে, নির্বাচন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় কাউন্সিল, দুমা(রাশিয়ান সংসদের লোকসভা), পৌর প্রশাসন, কর প্রদান এবং অন্যান্য অনেক আরও ক্ষেত্রে অভিজাত শ্রেণীর এই বাড়তি সুবিধাভোগের বিষয়টি স্পষ্ট লক্ষণীয়।

সমাজে কর প্রদানকারী নিচু স্তরের নিম্নবংশে জন্মলাভ করা সুবিধাহীন কৃষক শ্রেণীর মানুষেরা দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে কোনও অভিজাত ব্যক্তির তুলনায় দুর্বল বা কম বুদ্ধিসম্পন্ন নয়, এমনকি এই সত্যটি একেবারে নির্বোধ লোকের চোখেও ধরা পড়বে। কিন্তু অধিকারের প্রশ্নে সকল অভিজাত ব্যক্তিই সমান অধিকার ভোগ করে, যেমনটা কৃষক শ্রেণীর সবাই অধিকার বঞ্চিত জীবনযাপনের দিক থেকে সমান।

এখন কি আমাদের লিবারেল অধ্যাপক তুগানের মাথায় এটি ঢোকানো গেল যে সমান অধিকারের জায়গা থেকে সমতা এবং সমান শক্তি ও মনোবলের জায়গা থেকে সমতার ধারনার পার্থক্যগুলো কী কী?

তাহলে এবার অর্থনৈতিক সমতার বিষয়টির দিকে নজর দেয়া যাক একটু। যুক্তরাষ্ট্রের মত যেকোনও উন্নত রাষ্ট্রেই মধ্যযুগীয় বিশেষ সুবিধাগুলো ভোগ করার আর কোনও উপায় নেই। রাজনৈতিক অধিকারের দিক থেকে সকল নাগরিকই সমান। কিন্তু সামাজিক উৎপাদনশীলতার দিক থেকে কি সবাইকে সমান বিবেচনা করা হয়?

না, জনাব তুগান, এইক্ষেত্রে সবাইকে সমানভাবে বিবেচনা করা হয়না। অল্পসংখ্যক কিছু লোক যাদের নিজস্ব জমি, কারখানা এবং পুঁজি রয়েছে তারা শ্রমিকদের অবৈতনিক শ্রমের উপর নির্ভর করে জীবন ধারন করে থাকে। বাকি বেশিরভাগ জনগণেরই কোনও উৎপাদন প্রণালীর মালিকানা নেই এবং তারা শুধুমাত্র নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে, এদেরকে বলা হয় প্রলেতেরিয়াত।

যুক্তরাষ্ট্রে কোনও ধরনের অভিজাততান্ত্রিক সুবিধাভোগের উপায় নেই, এবং বুর্জোয়া শ্রেণী ও প্রলেতেরিয়াত শ্রেণী উভয়ই সমান রাজনৈতিক অধিকার পেয়ে থাকে। কিন্তু তারা শ্রেণীগত অবস্থান থেকে সমান নয়ঃ এক শ্রেণীর লোক যারা পুঁজিবাদী, তারা সকল ধরনের উৎপাদন প্রণালীর মালিকানা ভোগ করে এবং শ্রমিকদের অবৈতনিক শ্রমের উপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করে। অন্য শ্রেণী, বেতনভুক্ত প্রলেতেরিয়াত, যারা কোনও ধরনের উৎপাদন প্রণালীর মালিকানা ভোগ করতে পারেনা এবং নিজেদের শ্রমশক্তি বাজারে বিক্রি করার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

শ্রেণী উচ্ছেদ করে দেয়ার অর্থ হচ্ছে সকল নাগরিক একই অবস্থান থেকে উৎপাদন প্রণালীর সামাজিক মালিকানা ভোগ করবে এবং নিজেদের কাজে লাগাতে পারবে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, সকল নাগরিক জীবিকা নির্বাহের জন্য জনগণের মালিকানা ভিত্তিক উৎপাদন প্রণালীসমূহকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে, যেখানে জমি, কারখানা এবং ইত্যাদি সবকিছুর মালিক হবে যৌথভাবে জনগণ।

আমাদের পণ্ডিত লিবারেল অধ্যাপক জনাব তুগানকে বুঝানোর সুবিধার্থে সমাজতন্ত্রের মৌলিক সূত্র একেবারে সরলীকরণ করেই বলে দিলাম। এখন তিনি যদি খুব মনোনিবেশ করে কঠিন তপস্যা করতে পারেন, তবে তার পক্ষে হয়ত এটা বোঝা সম্ভব হবে যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ বলতে সবার দৈহিক ও মানসিক শক্তির সমতার কথা ভাবা হয় এমনটি মনে করা নিরর্থক।

এক কথায়, সমাজতান্ত্রিকরা যখন সমতার কথা বলে তখন তারা সামাজিক সমতা বুঝায়, সামাজিক অবস্থানের সমতা বুঝায়, কোনওপ্রকার ব্যক্তিভিত্তিক দৈহিক ও মানসিক সমতার ব্যাপারটিকে বুঝায় না।

কৌতুহলী পাঠক হয়তো কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে পারেনঃ একজন পণ্ডিতসুলভ লিবারেল অধ্যাপক তার মত মানুষ সমাজতন্ত্রের এমন মৌলিক সূত্রগুলোকে কীভাবে ভুলে গেলেন? এসব তো একজন সাধারণ পাঠকেরও জানা থাকার কথা! উত্তর খুবই সহজঃ বর্তমান দিনের অধ্যাপকদের ব্যক্তিত্ব এমনই ছ্যাচড়া স্বভাবের যে, এদের মধ্যে তুগানের মত বোকাচোদা লোকেরাও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় মাঝেমাঝে। এছাড়াও বুর্জোয়া সমাজে সামাজিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করলেও, শুধুমাত্র সেসব লোকেরাই এই অধ্যাপকের পদলাভ করে যারা পুঁজির স্বার্থে বিজ্ঞানকে বিক্রি করে দিতে পারে, যারা ক্ষমতাভোগী পুঁজিবাদী শ্রেণীর স্বার্থে জনগণের মাঝে স্টুপিড ননসেন্স আলাপ ছড়িয়ে বেড়ায়, ভন্ডামি ও ভাঁড়ামির চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় এবং সমাজতান্ত্রিকদের বিরুদ্ধে অর্থহীন বালখিল্যমূলক আতলামি করে বেড়ায়। বুর্জোয়া শ্রেণী এসব পোষ্য অধ্যাপকদেরকে মোটা অংকের বেতন দিয়ে থাকে এবং তাদের অর্থহীন আতলামো প্রমোট করে থাকে যতক্ষন পর্যন্ত তা সমাজতন্ত্রকে “খারিজ” করার কাজে লাগে।